50th World Environment Day: ৫০তম বিশ্ব পরিবেশ দিবসে নৈহাটির ডাক

প্রবীণের হাত ধরে পরিবেশ রক্ষার শপথ, নানা আয়োজনে ‘নাগরিক উদ্যোগ’
‘সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দশ বছরের বেশী স্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধে একাধিক রাসায়নিক বিষ আকাশ থেকে ছড়িয়ে বিস্তৃত বনাঞ্চলের গাছের পাতা খসিয়ে সমস্ত ভিয়েতনামের বনভূমি, মাটি ও জলকে বিষাক্ত করে দেয়। পৃথিবীজুড়ে সোচ্চার প্রতিবাদ ওঠে। এসব থেকে মুখ রক্ষারও প্রয়োজন ছিল আমেরিকা প্রোষিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির। আর এসবের যোগফলেই সেদিনের পরিবেশ দিবসের ঘোষণা’
কৌস্তুভ বসু ও সন্তোষ সেন
১৯৭২ সালে সুইডেন-এর স্টকহোম শহরে ৫ থেকে ৭ জুন রাষ্ট্রসংঘ আহূত মানব পরিবেশ বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি বসে। সম্মেলনের প্রথম দিনই ‘৫ জুন’কে বিশ্বপরিবেশ দিবস ঘোষণা করা হয়। এবারে পালিত হলো দিবসের ৫০তম বছর। প্রথম বছরের থিম ঊধৎঃয : ড়ঁৎ ড়হষু ঢ়ষধহবঃ' কেই ৫০তম বর্ষের থিম হিসাবেও ঘোষণা করা হয়েছে। এই সমাপতন তাৎপর্যপূর্ণ।
আমরা বলতে পারি এবং তথ্য-পরিসংখ্যান ও বাস্তব পরিস্থিতি দেখাচ্ছে যে মিসিসিপি-গঙ্গা-ভলগা দিয়ে এই পঞ্চাশ বছরে অনেক জল বয়ে গেলেও পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে দ্রুত হারে। বিশেষ করে বিগত তিন দশকে পরিবেশ বিনষ্ট হয়েছে সূচকীয় ঊর্দ্ধগতিতে। অর্থনীতির বিশ্বায়ন সারা বিশ্বকে পুঁজির অবাধ ক্ষেত্রে পরিনত করার সঙ্গে সারা দুনিয়ায় চালান করেছে দূষণকেও । সমস্ত পৃথিবীতে জল-মাটি-বায়ুতে মৃত্যুর হাতছানি। ৭০ দশকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ঘোষণার অন্যতম কারণ ছিল পরিবেশ দূষণরোধী যান্ত্রিক ব্যবস্থাপণার মধ্যে দিয়ে পুঁজির বিনিয়োগ বাড়ানো। উৎপাদন ব্যবস্থা বজায় রাখার স্বার্থে তার প্রয়োজনটা ছিল সামাজিক দাবী।
যে দাবী অনেকটাই উঠে এসেছিল বড়ো কারখানার শ্রমিক ইউনিয়ন আর সত্তর দশকের আন্তজার্তিক বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের ফসল হিসাবে। উল্লেখযোগ্য যে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র দশ বছরের বেশী স্থায়ী ভিয়েতনাম যুদ্ধে একাধিক রাসায়নিক বিষ আকাশ থেকে ছড়িয়ে বিস্তৃত বনাঞ্চলের গাছের পাতা খসিয়ে সমস্ত ভিয়েতনামের বনভূমি, মাটি ও জলকে বিষাক্ত করে দেয়। এর কারণে লক্ষ-লক্ষ ভিয়েতনামবাসী নিহত হন। পৃথিবীজুড়ে এই হত্যাকান্ডের সোচ্চার প্রতিবাদ ওঠে।
এসব থেকে মুখ রক্ষারও প্রয়োজন ছিল আমেরিকা প্রোষিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির। আর এসবের যোগফলেই সেদিনের পরিবেশ দিবসের ঘোষণা। আজ, সোভিয়েত ও চিনের সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর ব্যক্তি পুঁজি হোক বা রাষ্ট্রীয় পুঁজি তা অনেক খুল্লামখুল্লা। বুর্জোয়া গণতন্ত্র এখন এন.জি.ও’র গণতন্ত্রের জন্য চিৎকারের কর্মসূচি। বাস্তবের অর্থ-পুঁজি আর বাজারের হাতধরাধরি সম্পর্কে গণতন্ত্র এক সোনার পাথর বাটি। ফলে চলছে অবাধ লুঠতরাজ--মানুষ ও প্রকৃতির।
দিনে দিনে পরিবেশ নিধন বাড়ছে। জ্বলছে জঙ্গল একের পর এক। একদিকে পৃথিবীকে ধ্বংস করার এই সমস্ত কারিগরেরা মুনাফার হিসেব কষে পুঁজি বাড়াচ্ছে ক্রমশ। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে পানীয় জলের চরম সংকট। ভূউষ্ণায়ন, বরফের অতি দ্রুতহারে গলন, সমুদ্র জলের তাপমাত্রা বাড়ছে, ফুলেফেঁপে উঠছে জলস্তর। অসময়ে অতিবৃষ্টি-বন্যা-প্লাবন তীব্র তাপপ্রবাহ, খরা ও দাবানল ঘটে চলেছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে এইসব অঘটনগুলোই আজ স্বাভাবিক ও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথে সুন্দরবনের মতো উপকূলীয় অঞ্চলগুলো ডুবতে বসেছে জলের তলায়। আইপিসিসি’র রিপোর্ট মিলে যাচ্ছে ছত্রে ছত্রে।
আইপিসিসি’র ষষ্ঠ রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ স্পষ্ট। বেশি হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কম করে ৪০০টি উপকূলবর্তী শহর জলের তলায় তলিয়ে যাবে। কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, নয়ডার মতো মেট্রো শহরগুলিকে বলা হচ্ছে ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’। শহর ও শহরতলীর জলাশয়- জলাভূমি উন্নয়নের করাল গ্রাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চার লেন-ছয় লেনের রাস্তার জন্য নির্বিচারে কাটা পড়ছে সুবৃহৎ সবুজ বনানী। গাছপালা অত্যন্ত কমে যাওয়ায় ও শহরে কৃষিকাজ না থাকায় এবং কংক্রিটের জঙ্গল আরো বিস্তৃত হওয়ায় শহরগুলোতে রোদের তাপ প্রচুর পরিমাণে ঢুকলেও তা আর বিকিরিত হয়ে ফিরে যেতে পারছে না।
শহরগুলি এক একটি তপ্ত কড়াইয়ের ওপর অবস্থান করছে। এইসব সতর্কবার্তা আজ কেবল কথার কথা বা ভয় দেখানোর বিষয় নয়। চলতি বছরে (২০২২) এপ্রিল-মে মাসে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, তাপপ্রবাহ আর দূষিত আবহাওয়ার হাত ধরে হাঁসফাঁস করা শহরবাসী ও শহরে কাজ করতে আসা মানুষজন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তার আগে শীতের সময় বারবার ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে হেক্টরের পর হেক্টর কৃষিজমি জলের তলায় চলে যাওয়ায় কৃষকরা সর্বস্বান্ত হলেন। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল কৃষিপণ্যের দাম। প্রতিবছর এই ধরণের অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা বিশ্ববাসীর কাছে আরো ভয়ানক ও ভয়াবহ আকারে হাজির হবে।
অতি সাম্প্রতি ঘটে গেল দুটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক (নাকি মনুষ্যসৃষ্ট) দুর্যোগ । ৭ মে চীন-পাকিস্তান সংযোগকারী একটি ঐতিহাসিক ব্রিজ সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে তলিয়ে গেল জলের তলায়। পাকিস্তানের কারাকোরাম হাইওয়ের সন্নিকটে চীনের সাথে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ‘হাসানাবাদ সেতু’র ভেঙ্গে পড়ার কারণ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, এপ্রিল মাস জুড়ে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ওখানকার গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে আট থেকে দশ ডিগ্রি বেশি। অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তাপপ্রবাহের কারণে একটি বিশাল আকারের বরফের পাহাড় (ঝযরংঢ়বৎ মষধপরবৎ) সম্পূর্ণরূপে গলে যায়। ফলে নদীতে প্রবল জলস্ফীতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল ব্রীজটিকে। প্রবল জলস্রোতের কারণে সেতুর সাথে সাথে দুটি জল-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রচুর বাড়ি, আবাসন, প্রশাসনিক ভবনও তলিয়ে গেছে।
অন্যদিকে বন্যায় বেসামাল আসাম ও অরুনাচলপ্রদেশ। ১৬ মে, ২০২২ থেকে লাগাতার ভারী বৃষ্টি ও ভূমিধ্বসে আসামের ২৯টি জেলার আট লক্ষের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। এই বিপর্যয় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সূচনা। ১৫ মে, ২০২২ আসামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আসামের ডিমা হাসাও জেলার হাফলং স্টেশন ভারী বৃষ্টি ও কাদা ধ্বসের কারণে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়েছে। প্রায় গোটা জেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন, বাতিল ১৭ রুটের ট্রেন। উত্তর-পশ্চিম ভারত যখন তীব্র দাবদাহে দগ্ধ হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই আসাম, অরুনাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, মনিপুরসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত। একরের পর একর চাষের জমি জলের তলায়, ভেঙে পড়েছে একাধিক সড়ক ও রেল ব্রীজসহ অসংখ্য বাড়িঘর, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করেন।
অন্যদিকে চলতি বছরে ১৮০ টি সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝার পূর্বাভাস আছে, তার মধ্যে অশনি কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। এই প্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই আমাদের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন। শক্তি ব্যবহারের বৈষম্যে ভুক্তভুগী হচ্ছেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। হিসেব কষলে দেখব পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শক্তির ভান্ডার করায়ত্ত করে রেখেছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি। কখনও নদীর গতিপথকে বাঁকিয়ে বা কখনও জঙ্গল নিধন করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে। লড়াইটা আমাদের জল- জঙ্গল- জমিকে ধ্বংস হতে দেওয়ার বিরুদ্ধে। শক্তির অপচয়ের বিরুদ্ধে। একটাই পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে পৃথিবীতে হবে সমস্ত শক্তিভান্ডারের সুষম বন্টন।
এই চর্চাকেই জোরের সাথে সামনে আনছে ‘পরিবেশ বিষয়ক নাগরিক উদ্যোগ’। সাধারণ মানুষকে পরিবেশ প্রশ্নে ভাবিত করে তুলতে গান, কবিতা, অঙ্কন, নাটকের ডালি সাজিয়ে এলাকার সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে মিলিত ভাবে পথ চলছে এই উদ্যোগ। একটাই পৃথিবী, এই পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখার দাবিতে পোষ্টার, প্ল্যাকার্ড ব্যানার ও সহযোগে বর্ণাঢ্য পদযাত্রাটি নৈহাটি পৌরসভার সামনে থেকে শুরু হয় চঘঅঈ মাঠের সামনের পার্কে এসে শেষ হয়।
সেখানে দিনভর নানান আয়োজন চলে রাত ৯ টা পর্যন্ত। পায়রাকে খাঁচার মুক্ত করা দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। এর পর পার্কে বৃক্ষ রোপন, পরিবেশ বিষয়ক কবিতা পাঠ। ছোটদের ছবি আঁকা। কাগজ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের পরিবেশ বান্ধব জিনিস তৈরি করা, পরিবেশ ঘিরে মনোমুগ্ধকর গান পরিবেশন ইত্যাদি ছাড়াও রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশন, মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশকে কেন্দ্র করে বোলপুর নিবাসী পীযূষ মুখোপাধ্যায়ের নিজের আঁকা বেশকিছু ছবির প্রদর্শন ও কিছু কথা দিয়ে পরিবেশ বাঁচাও অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। সার্বিক সাংস্কৃতিক আয়োজনে নৈহাটির অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থার বন্ধুরা।