Alternative school home : পাড়ায় শিক্ষালয়: বিকল্প স্কুল বাড়ি?

ছবি লেখক
ড: বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ
গত দুবছর ধরে বন্ধ প্রাথমিক শিক্ষার আঙিনা।উচ্চ বিদ্যালয় কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও ধারাবাহিকতায় চলেনি পড়াশোনা।করোনা এক একটি ভ্যারিয়েন্ট এর আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় বন্ধ হয়ে গেছে দরজা।কচিকাঁচারা বন্ধ জানালা বা গেটের ওপর থেকে আকুল ভাবে তাকিয়ে থেকে বাইরে।বেরোবার অনুমতি নেই তাদের।মেলেনি স্কুল এ যাবার অনুমতি।একটা বাড়িতে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে তারা।স্তব্ধ হয়েগেছে মানসিক ও শারীরিক বিকাশ।ইন্টারনেট,অ্যাপ নির্ভর পড়াশোনা করতে গিয়ে কম্পিউটার, সেল ফোনএর সঙ্গে গড়ে উঠেছে যান্ত্রিক সখ্যতা।কি ভয়ানক এর পরিণতি ভাবলেও হাত কামড়েছে অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
সত্যি কি প্রয়োজন নেই আর সশরীরে বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনার ? বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক জন ডিউই বলেছিলেন "বিদ্যালয় হল সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি" ।কি মূল্যবান একটি বক্তব্য তাইনা? ভুলতে বসেছি আমরা।পরিবারের পর শিক্ষাদানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো বিদ্যালয়।
আজকের শিশুরা আগামী দিনের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের বিকাশ আমাদের দেশের ভবিষ্যতের সমান্তরাল,যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার গুণমানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। একটি স্কুলকে অবশ্যই শিশুদের মধ্যে কৌতূহল উদ্দীপিত করে, প্রভাবশালী মনের মধ্যে নিত্য নতুন ছবি অঙ্কন করে আর এবং তাদেরকে আরও ভালো মানুষ হওয়ার জন্য নানা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করে তোলে।
এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ধারণা যে শেখার প্রক্রিয়া একজনের ব্যক্তিত্ব গঠনে এবং জীবনের পরিস্থিতির সাথে সে যেভাবে মোকাবেলা করে তার জন্য সহায়ক। বইয়ের জ্ঞান থেকে জীবনের জ্ঞানের দিকে চিন্তার স্থানান্তর, স্কুলগুলিতে, পরিবর্তনের ঢেউ নিয়ে এসেছে। মানুষ শুধুমাত্র ডিগ্রী অর্জন এবং জীবনে আর্থিক সাফল্য অর্জনের উপায়ের পরিবর্তে শিক্ষাকে একটি সুষ্ঠু উন্নয়নের চাবিকাঠি বলে মনে করেছে আর তার প্রিয় বাড়ি হয়ে উঠেছে স্কুল বাড়িটি। শিক্ষাকে অবশ্যই একটি সুস্থ চিন্তা প্রক্রিয়ার বিকাশের সুবিধা দিতে হবে এবং শিশুর বৌদ্ধিক ক্ষমতাকে উন্নত করতে হবে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের পর শিক্ষা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন টা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিদ্যালয় শিক্ষা অবশ্যই নিম্নলিখিত দিকগুলিতে ফোকাস করে যা শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সাথে সাথে তাদের সর্বাঙ্গীন বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখে।
মানসিক দিক:স্কুল হল শিশুদের জ্ঞানের সবচেয়ে বড় উৎস। এটি তাদের জন্য শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন মানুষ, সাহিত্য, ইতিহাস, গণিত,ভূগোল,ভাষা,বিজ্ঞান ,সমাজনীতি এবং অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দেয়। এটি চিন্তা প্রক্রিয়ায় বিকাশে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যখন কেউ শিক্ষালয় নামক সামাজিক উৎস থেকে আগত প্রভাবের সংস্পর্শে আসে, তখন তার সম্মুখের বিশ্ব এবং ও সেখানে তার অস্তিত্বর বিশালত্ব অনুভব করে।
সামাজিক দিক: বিদ্যালয় হল একটি শিশুর সামাজিকীকরণের প্রথম উপায়। তখন পর্যন্ত, বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যরাই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে শিশুর মানবিক মিথস্ক্রিয়া হয়। আর পরিচিতি হল স্থবিরতার প্রজনন ক্ষেত্র। স্কুলগুলির সাথে, শিশুরা কেবল নতুন ধারণার সাথেই নয়, একই বয়সী দেশবাসীদের কাছেও উন্মুক্ত হয়। এটি সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, অংশগ্রহণ, সহায়তার মতো সামাজিক অভ্যাস গড়ে তোলে যা তাদের প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।শিক্ষালয় ব্যক্তি মানুষ কে সামাজিক মানুষের পরিণত করে।মনে পড়ে গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এর বিখ্যাত উক্তি" মানুষ একটি সামাজিক জীব।"
শারীরিক দিক:একটি শিশু, গর্ভধারণের পরে, বিভিন্ন শারীরিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যায়। যদিও বাড়ি একটি সীমাবদ্ধ পরিসেবা সরবরাহ করে, স্কুলে, একটি শিশু তার শক্তিকে আরও সামাজিক উপায়ে চালিত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে পরিচিত পরিবেশে থাকালকালীন শিশুর ভেতর যে সক্রিয়তার অভাব থাকে বিদ্যালয়ের সংস্পর্শে আসলেই ক্রমে সে তার সর্বোত্তম আচরণ করতে শেখে। এছাড়াও, শরীরচর্চা খেলাধুলা, বিভিন্ন দক্ষতার বিকাশের মতো ক্রিয়াকলাপের উপস্থিতিতে শিশুদের তাদের সীমাহীন শক্তিকে উৎপাদনশীলতায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয় ওঠে।
সার্বিক উন্নয়ন:আগে, বিদ্যালয়গুলিকে পুঁথিগত শিক্ষা অর্জনের প্রতিষ্ঠান বলে বিবেচনা করা হত। বর্তমান শিক্ষাগত পরিস্থিতিতে, তথা শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষায় একটি শিশু প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে যেতে শেখে। বিদ্যালয় তাদের নিজস্ব একটি মন তৈরি করতে শেখায় এবং নমনীয় পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে, কৌতূহল জাগিয়ে তোলা হয়। শিশু তার মানসিক অবরোধের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় এবং তার কল্পনাকে নিজস্ব গতিপথ চালনা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। কল্পনার গুরুত্বের উপর ব্যাপকভাবে জোর দেওয়া হয়। খেলা, সক্রিয়তামূলক কার্যক্রম, একটি পরিবেষ্টিত পাঠ্যক্রম এর মাধ্যমে শিশু ক্রমশ উন্নত প্রজ্ঞামুলক সিস্টেমের দিকে পরিচালিত হয়।যা তার লক্ষ্য গুলিকে বাস্তবায়িত করতে তাকে সক্ষম করে তোলে।
জীবন বাঁচার পাশাপাশি শেখার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও আমরা আমাদের পিতামাতার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে শিখতে পারি, তারা অনেকটা একতরফা হতে থাকে। বিদ্যালয়ের পরিবেশে বাচ্চারা বিভিন্ন উৎসের সংস্পর্শে আসে যেখান থেকে তাদের বিকাশের জন্য সহায়ক।বিদ্যালয় শিশুদের সামাজিক ধ্যানধারণা,রীতিনীতি, অধিকার,কর্তব্য ও মূল্যবোধের শিক্ষা প্রদান করে।তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে পরিচিত করে ও উন্নত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়।আর এ সবের মূল ক্যাটালিস্ট হলেন শিক্ষক স্বয়ং।তিনি তার উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে শিশু নামক মাটির তাল কে আসতে আস্তে একার দেন।তাই শিশুদেরদের জীবনের কর্মকাণ্ডে শিক্ষিত করার জন্য বিদ্যালয় তথা শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষালয় যে কোনো সমাজের ভিত্তি তৈরি করে। এটি সাধারণভাবে সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য দায়ী। সমাজের বিকাশের সুতোটি নির্ভর করে শিক্ষার মানের উপর। তাই একটি জাতির ভবিষ্যতকে তার ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি শিক্ষালয় ও শিক্ষকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গত দুবছর যাবৎ বন্ধ থাকার পর পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষাদফতর এর উদ্যোগে আজ থেকে শুরু হলো পাড়ায় শিক্ষালয়। শিশু পড়ুয়া তথা অভিভাবক দের নিকট যা অনেকটা স্বস্তির বাতাস এনেছে।কিন্তু আদৌ কতটা সম্ভব এভাবে শিক্ষাদান?তাহলে কি হারিয়ে যাবে স্কুলবাড়ির প্রতিচ্ছবি?
কিন্তু শিক্ষক তথা অভিভাবক সবার কাছেই এখন পরিষ্কার অনলাইন শিক্ষা অপেক্ষা মুখোমুখি তথা বিদ্যালয় ভিত্তিক শিক্ষা অনেক বেশি ফলপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ন ।কিন্তু এর জন্য চাই সরকারি অনুমোদন। তা মিললে করোনা বিধি বজায় রেখে স্কুলেই চলতে পারে পাঠদান প্রক্রিয়া।কারণ পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষালয় কে অনেকেই খুব একটা নিরাপদ মনে করছেন না।আবার দীর্ঘকালীন ভাবে অধিক ছাত্র যুক্ত বিদ্যালয় গুলিতে এই ধরনের পাঠ দান সম্ভব নয়।শৌচাগার,পানীয় জল ইত্যাদির
সমস্যার কথা অনেক ক্ষেত্রেই উঠে এসেছে।এবং সেইবসঙ্গে বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলি থেকে শিক্ষালয় এর গুরুত্বের কোথাও উঠে এসেছে।আশাকরা যায় পরীক্ষামূকভাবে এই ধরনের বিদ্যালয় কিছুদিন চালানোর পর দীর্ঘ কালীন প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে বিদ্যালয় গুলি খোলার অনুমতি মিলবে।স্কুলের প্রার্থনা গৃহ আবার গম গম করবে শিক্ষার্থীদের স্বরে।শিক্ষকদের ধমক আর ভালোবাসার মাঝে কচিকাঁচারা দাপিয়ে বেড়াবে খেলার মাঠ। ইউনিফর্ম পরা ঝক ঝকে চেহারা গুলো অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াবে।ছুটির ঘন্টা আবার বেজে উঠবে স্কুল বাড়িটার দেওয়ালে।
লেখক: বিরাজলক্ষী ঘোষ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, পরিবেশ সংগঠক ও সমাজচিন্তক