Asia's largest Durga Puja: এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজার আয়োজক ‘লিটন শিকদার’

ছবি শিকদার বাড়ির পুজোর প্রতিমা
অনিরুদ্ধ
মন খারাপ লিটন শিকদারের। মুঠোফোনে কথা বলার সময়ই কিছুটা আঁচ করা গিয়েছিলো-লিটন বাবুর মন ভালো নেই। আর ভালোইবা থাকে কিভাবে বলুন? যেখানে এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপুজার আয়োজক তিনি, সেখানে চলমান পুজোয় তার মন ভরছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। অতিমারির গত দুই বছর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ নিয়ে অপেক্ষায় দিন কাটিয়েছেন লিটন বাবু। নিজের চেয়েও বেশি মন খারাপ এলাকার মানুষের কথা, অতিথিদের কথা ভেবে। সারাটি বছর এলাকাবাসী ছাড়াও দূরদুরান্তের হাজারো মানুষের পদচারণনায় মুখরিত হয়ে ওঠতো যে শিকদার বাড়ি, তা এখন অনেকটা আনন্দহীন।
লিটন বাবুর সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন মাঝে মাঝেই তার গলা ধরে আসছিল। প্রকাশ না করলেও বেশ বোঝা যাচ্ছিল। ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষটি কেমন অসহায়বোধ করছেন। তার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তারপরও সাহসে বুক বেধে আগামী বছরের অপেক্ষা রয়েছেন। লিটন বাবু জানালেন, তাদের বাড়ির পূজোর প্রতিমা গড়াতে এক লম্বা সময়ের প্রয়োজন হয়। এপ্রিল থেকেই বেশ কয়েকডজন কারিগর প্রতিমা গড়ার কাজে লেগে যান। নতুবা এতো সংখ্যক প্রতিমা গড়াতো সম্ভব নয়।
কেন এতো বড় পূজো
সোজা হয়ে বসলেন লিটন বাবু। বলেন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যুগে ধর্ম সম্পর্কে আগামী প্রজন্মের আগ্রহের ভাটা তিনি লক্ষ্য করেছেন। সত্য, ত্রেতা, দ্রাবর ও কলিযুগ পর্যন্ত যেসব অবতার এসেছেন, তাদের মূর্ত্তির সমন্বয়ে আগামী প্রজন্মকে সনাতনধর্মের ইতিহা-ঐতিহ্য সম্পর্কে সজাগ করে তোলার লক্ষ্যেই এই পুজোর আয়োজন করে থাকেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ৮০১টি মূর্তির সমন্বয়ে দুর্গাপুজার আয়োজন করা হয়। যা কিনা এশিয়ার আর কোন দেশে এমন আয়োজন হয়েছে বলে জানা নেই।
এশিয়ার সর্ববৃহৎ দুর্গাপুজার আয়োজক লিটন শিকদারকে ‘ সম্মাননা স্মারক’
প্রয়াত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ
একটু বিরতি নিয়ে লিটন বাবু জানালেন, প্রয়াত বাবাই এই বিশাল আয়োজনের নজির গড়েন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই লিটন বাবুও পূজোর কলেবর বৃদ্ধির চেষ্টা করে চলেছেন এবং প্রতিবছরই এর কলেবর বাড়ছে। ২০১০ সালে ২৫১টি প্রতিমা নিয়ে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তারপর বাবা প্রয়াত হন। কিন্তু লিটন বাবু থেমে যাননি। স্বজনরা তাকে সাহস যুগয়েছে। স্ত্রী-সন্তানরাও চায় শিকদার বাড়ির ঐতিহ্যের শ্রীবৃদ্ধি। ২০১৯ সালেও ৮০১টি প্রতিমা নিয়ে এই বাড়িতে পূজা উদযাপিত হয়েছে।
অজানা ভাইরাস কবলিত প্রথিবী
২০২০ সাল। আচমকা বিশ্ববাসী এক নবাগত ভাইরাসের সঙ্গে পরিচিত হলো। যুগে যুগে পৃথিবীতে বহু ভাইরাস এসেছে, তবে তা ছিল একটা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। কিন্তু করোনা তথা কভিড-১৯ এর মতো এতোটা বিধ্বংসী এবং গোটা পৃথিবী গ্রাস করেনি। কেড়ে নেয়নি লাখো প্রাণ! মানুষে মানুষে যোগাযোগ বন্ধই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, অফিস-আদালত, যানবাহন সব বন্ধু। এমন কী মানুষকে রক্ষায় সন্ধ্য আইন পর্যন্ত জারি করতে হয়েছে। সকল উৎসব বন্ধ থাকে। যেখানে করোনায় মৃত বাবা-মা ভাইবোন ও স্বজনের মরদেহ সৎকার পর্যন্ত করতে কেউ পাশে যাচ্ছে না, মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে উৎসবতো বহু দূর। কারণ, যে মানুষের জন্য উৎসব-সেই মানুষই তো ঘরবন্ধী!
অন্ধকারাচ্ছন্ন আলোকজ্জ্বল মঞ্চ
এমন পরিস্থিতিতে শিকদার বাড়ির মহা আয়োজনে ভাটা পড়ে। করোনার প্রভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন শিকদার বাড়ির আলোকজ্জ্বল মঞ্চ। চীনের উহান প্রদেশ থেকে গোটা দুনিয়ায় আছড়ে পড়া ভাইরাস দুই বছর গোটা পৃথিবী কাঁপিয়ে অবশেষে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে তলানি নামতে থাকে। কিন্তু মাত্র করেয়ক মাসে শিকদার বাড়ির মহা উৎসবের প্রতিমা গড়ার কাজ সম্পন্ন হবে না। তাই এবছরও গতানুগতিকভাবেই পুজোর করছেন লিটন বাবুরা।
কিলোমিটার জুড়ে মেলা
দূরদুরান্ত থেকে ভ্রমণ পিপাসু ও সাংস্কৃতি মনা মানুষজন ছুটে আসেন শিকদার বাড়ি। অতিথি নারায়ন ভেবেই আপ্যায়নে কোন খামতি রাখেন না আয়োজকরা। মহা আয়োজন ঘিরে যেখানে মানুষের পদচারণায় মুখরিত গোটা এলাকা, সেখানে মেলার আয়োজন থাকবে না, তা কি করে হয়? তাই এক কিলোমিটার জুড়ে বিনোদনের নানা আয়োজন। সঙ্গে নানা পদের খাবার ও পণ্যের পসরা।
দুর্গোৎসবের স্মারক ‘শিকদার বাড়ি’
ঢাকা থেকে বাগেরহাটের দূরত্ব ২১৫ কিলোমিটারের মত। বাগের জেলার একাংশে রয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। শিকদার বাড়ি যেতে হলে বাগেরহাট সদর অব্দি যেতে হবে না। প্রায় ১৫/২০ কিলোমিটার আগে খুলনা-বাগেরহাট ও মোংলা বন্দরে যাবার মোহনা কাটাখালি নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে যেকোন টোটো বা অটো রিকশাকে শিকদার বাড়ির কথা বলে ওঠে পড়লেই হলো। ২০/২৫ মিনিটের মধ্যে আপনাকে পৌছে দেবে শিকদার বাড়ির আঙ্গির সামনে। বাগেরহাট সদর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের হাকিমপুর গ্রামে অবস্থিত শিকদার বাড়ি।
শেষ কথা
ফের লিটন বাবুর কাছে জানতে চাইলাম প্রথম আয়োজনের গল্পটা। লিটন শিকদার জানালেন, আগেই বলেছি বাবার দেখানো পথেই আমিও এগুচ্ছি। সময়টা ২০১০ সাল। তখন শিকদার বাড়ির পুজোর মহাআয়োজনের হাল আমাকেই ধরতে হল। শুরুতে ২০১টি প্রতিমা দিয়ে আয়োজনের গোড়াপত্তন। স্থানীয় লোকজনের উৎসাহে দিন দিন প্রতিমার সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি বছর হাকিমপুর গ্রামে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের বাইরের দর্শনার্থীরা আসেন। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। শিকদার বাড়ি মহা আয়োজনের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এবারে ওঠার পালা। মনে মনে কর্মবীর ‘লিটন বাবুকে’ সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম।