Environment : বর্তমানের ও ভবিষ্যতের জলচিত্র

সন্তোষ সেন
বিগত কয়েকদিন ধরে প্রবল বৃষ্টিতে ভাসছে চেন্নাইয়ের এক বড় অংশ। ইতিমধ্যেই ১২ হাজার মানুষকে বিভিন্ন ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্কুল কলেজ বন্ধ, অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বৃষ্টিতে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, গত ২০০ বছরে এমন বৃষ্টি কার্যত হয়নি এই রাজ্যে।
বিগত কয়েক মাস ধরেই আমরা দেখছি, কলকাতা, দুই মেদিনীপুর, ঘাটাল, আরামবাগ, বর্ধমানসহ পশ্চিমবঙ্গের এক বিস্তৃন অঞ্চল, মুম্বাই, চেন্নাইসহ ভারতের বেশ কিছু বড় শহর অতিবৃষ্টি, বন্যা , প্লাবন ও ধ্বসে বিপর্যস্ত হচ্ছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের জীবনযাপন। বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুর খবরও পাচ্ছি আমরা। এটাই কি আগামী দিনের নিউ নরমাল?
ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন। আসুন বিপর্যস্ত প্রকৃতি-পরিবেশ মেরামতি করতে সকলে মিলে কিছু করি, পথে নামি। না হলে শেষের সেই দিনের ভয়ঙ্কর অবস্থার প্রহর গুনতে হবে মানব প্রজাতিকে।
ভবিষ্যতের আরো কিছু জলমগ্নতার দিকে চোখ রাখা যাক এবার।
ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তকমা পাওয়া জীব-বৈচিত্র্যময় অঞ্চল সুন্দরবনে ঘুরতে গিয়ে দেখলেন সব দ্বীপগুলো জলের তলায় তলিয়ে গেছে, চারদিকে শুধুই নদী আর সমুদ্র--শুধু জল আর জল । এর মধ্যেই মৌসুনি ও ঘোড়ামারা দ্বীপের অনেকটা অংশ জলের নিচে চলে গিয়েছে।
ইডেন গার্ডেন্সে আর ক্রিকেট খেলা হয় না, কারণ গঙ্গায় জোয়ার এলেই মাঠ ডুবে যায় কোমরসমান জলে। তাই ক্রিকেটরা ওয়াটার-পোলো খেলা শিখে নিয়েছেন।
বোম্বাইয়ের ‘মেরিন ড্রাইভ’ এর অস্তিত্ব শুধুই পুরনো ছবির অ্যালবামে। ‘কুইন্স নেকলেস’ তলিয়ে গেছে আরব সাগরের জলে।
গুজরাটের ওখলা অঞ্চলের পরিণতি হয়েছে পুরাণের দ্বারকার মত, অর্থাৎ ওখানে এখন বিরাজ করছে শুধুই সমুদ্র।
না না এসব কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। এমনই হাড় হিম করা সব তথ্য উঠে এসেছে আইপিসিসির ষষ্ঠ রিপোর্টে, নাসার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এবং অতি সম্প্রতি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে গবেষণারত সংস্থা ‘ক্লাইমেট সেন্ট্রাল’ এর সমীক্ষায়। ভবিষ্যতের জলছবি বিশ্লেষণ করতে এই সংস্থা ব্যবহার করেছিল এক উন্নত প্রযুক্তি, যার পোশাকি নাম ‘কোস্টাল রিস্ক স্ক্রিনিং’ টুল । তাতেই ধরা পড়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যেই দেশের
১২টি শহর (বোম্বাই, চেন্নাই, বিশাখাপত্তনম, কান্ডলা, ওখলা, ভাবনগর, মোর্মুগাঁও, ম্যাঙ্গালোর, কোচিন, পারাদ্বীপ ও তুতিকোরিন) সমুদ্রের জলে প্লাবিত হবে, পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কাও প্রবল।
পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটাও বেশ উদ্বেগজনক। সুন্দরবন, খিদিরপুরসহ কলকাতার এক বড় অংশ জলের তলায় চলে যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এইভাবে চলতে থাকলে দমদম থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত বন্যায় বিপর্যস্ত হবে সংঘাতিকভাবে।
ভুউষ্ণায়ন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হাত ধরে দুই মেরুর ও হিমালয়ের বরফের চাদর গলছে অতি দ্রুত হারে, বাড়ছে সমুদ্র জলের উচ্চতা ও উষ্ণতা। এসবের হাত ধরে আগামী দশ বছরের মধ্যেই উপরের ছবিগুলো কল্পবিজ্ঞান থেকে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়বে। এই বছর (২০২০) জুন থেকে অগাস্ট মাস পর্যন্ত বিশ্ববাসী গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করলেন, গ্রীস, কানাডা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, ক্যালিফোর্নিয়ার হাজারে হাজারে মানুষ তীব্র তাপপ্রবাহ ও ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার দাবানলে জ্বলে পুড়ে হাঁসফাঁস করলেন, মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়লেন কয়েকশত মানুষ। আর ঠিক একই সময়ে গ্লোবের অন্যপ্রান্ত চীন জাপান বিপর্যস্ত হলো অতিবৃষ্টি, বন্যা ও প্লাবনে। অর্থাৎ একই সময়ে বিশ্ববাসী স্বাক্ষী থাকছেন সব রকমের এক্সট্রিম জলবায়ুর চরম ঘটনার, আগামীদিনে এইসব মনুষ্যকৃত বিপর্যয় আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।
তাই ২০৭০ সালে কার্বন নিষ্ক্রমণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার শুকনো প্রতিশ্রুতিতে আর চিঁড়ে ভিজবে না। প্রকৃতি ততদিন সময় দেবে না আমাদের। তাই সাধু সাবধান। না হলে ভবিষ্যতে কোমরসমান জলে দাঁড়িয়েই মিটিং-মিছিলসহ সব কাজ করতে হবে।
লেখক : বিজ্ঞান শিক্ষক সেন্ট জেভয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল, কলকাতা