Environment : পরিবেশ বাঁচানোর দাবিতে ‘আঠারো’  আসুক নেমে পৃথিবীর বুকে

Environment : পরিবেশ বাঁচানোর দাবিতে ‘আঠারো’  আসুক নেমে পৃথিবীর বুকে

সন্তোষ সেন

‘--- এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে
 এ বয়স জেনো ভীরু কাপুরুষ নয় 
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে 
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়
 এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে’

শুরুর কথা 

প্রকৃতি পরিবেশের বিপর্যয় আজ আর শুধু স্কুলের পাঠ্য বা কিছু বিজ্ঞান কর্মীদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিষয় নয়। আজ তা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে এক গ্লোবাল ফেনোমেনন। তাই এই বিপর্যয়কে বুঝতে হলে কাঁটাতারের প্রাচীর ভেদ করে আমাদের ভাবতে হবে অনেক গভীরে, বিশ্বপরিসরে। আন্তর্জাতিকস্তরেই ছাত্র-ছাত্রী, কিশোর-কিশোরী, যুবা বাহিনী, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কিছুটা মাত্রায় হলেও এগিয়ে আসছেন। বিশ্বজুড়ে রাজপথ কাঁপিয়ে দাবি উঠেছে, ‘ We need system change, not climate change. We need climate actions and we need right now"।

আমেরিকা ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই উপমহাদেশেও সমাজের নানা স্তরের মানুষ এসব নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, কিছু করার চেষ্টা করছেন। পরিবেশ পুনরুদ্ধারের স্ফুলিঙ্গ এ রাজ্যেও ইতিউতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগুনের লেলিহান শিখা জঙ্গল ছাড়িয়ে কড়া নাড়ছে আপনার-আমার দোরে, যা আমাদের রোজকার জীবনে প্রতিদিন টেরও পাচ্ছি অল্পবিস্তর। বিপর্যস্ত প্রকৃতি-পরিবেশের কুপ্রভাব আগামী দিনে সুনামি হয়ে আছড়ে পড়বে বিশ্ববাসীর দরবারে--এটা আজ তর্কাতীত। আইপিসিসির ষষ্ঠ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের ১২ টি শহর জলের তলায় তলিয়ে যাবে। মুম্বাই- চেন্নাই- কোচি- বিশাখাপত্তনম হয়ে সমুদ্রের জলস্ফীতি গ্রাস করে নেবে সুন্দরবন, খিদিরপুর, কোলকাতা শহরকেও। আশঙ্কা করা হচ্ছে ভেসে যাবে দমদম-ব্যারাকপুরসহ দুই চব্বিশপরগনা ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে বাড়ছে বায়ু দূষণ, জল দূষণ। বিপন্ন হচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। 
 
ক্যান্সারসহ কিডনি, ফুসফুসের নানা রোগ থাবা বসাচ্ছে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। তাই বিপর্যস্ত পরিবেশকে বুঝতে ও তার মোকাবিলায় ভাবতে হবে এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখেই। এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, সমাজের একটা ছোট অংশের পাহাড় প্রমাণ মুনাফা ও লোভ-লালসার করালগ্রাসে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত লুট হয়ে যাচ্ছে আমাদের জল জঙ্গল জমি, নদী পুকুর, খনিজ সম্পদ সব। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তথাকথিত উন্নয়ন ও নগরায়নের ঠেলায় প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের বিপর্যয় এক সাংঘাতিক মাত্রায় হাজির হয়েছে বিশ্ববাসীর দরবারে। এই নীল গ্রহে মানব সভ্যতার টিকে থাকাটাই আজ এক বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি। অন্যদিকে একের পর এক জলবায়ু সম্মেলনে রাষ্ট্রনেতাদের গালভরা প্রতিশ্রুতি ও গ্রিন টেকনোলজির নামে নতুন নতুন বিনিয়োগ ও মুনাফা বৃদ্ধির সুচতুর প্রয়াস ব্যথিত করছে আন্দোলনরত কচিকাঁচাদের কোমল হৃদয়।

তরুণ সমাজের ভূমিকা:

 প্রকৃতি ও পরিবেশের বিপর্যয়কে রুখতে হলে ছাত্র-যুবদের এগিয়ে আসতে হবে সামনের সারিতে। যে কাজ সুইডেনের তরুণী পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ এর হাত ধরে ২০১৮ সাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে সারা বিশ্বজুড়ে। এই আন্দোলনকে আমাদের রাজ্য তথা দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিতে হবে ‘তরুণ-তরুণীদের যৌবনের উন্মাদনা-উচ্ছলতা’কে সাথী করে। পরিবেশ আন্দোলনে তোমাদের ভূমিকা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? কালের অমোঘ নিয়মে আমরা বড়রা-প্রাজ্ঞরা  অধিকাংশই আর কটা বছর পর একে একে বিদায় নেব এই ধরণীতল থেকে। 

কিন্তু তোমাদের সামনে পড়ে রয়েছে সারাটা জীবন। ইঁদুর দৌড়ের লম্বা রেসে ভালো ছাত্র(!) হয়ে, ভালো পড়াশোনা (!) করে, একটা চলনসই কাজ জুটিয়ে তোমরা কি নিজেদের সঁপে দেবে মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্কীর্ণ পরিসরে? প্রকৃতি থেকে-সমাজ  থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের তথাকথিত সুরক্ষার বর্মে কি আটকে রাখতে পারবে? ভালোভাবে বাঁচতে হলে তো চাই চারপাশে একটা দূষণহীন সুন্দর নির্মল পরিবেশ। মুষ্টিমেয় মানুষের পাহাড় প্রমাণ মুনাফা ও লোভ-লালসার করালগ্রাসে তোমাদের চারপাশের পরিবেশটাই দূষিত-বিষাক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। 

আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাচ্ছি ধুলো-ধোঁয়া-বিষাক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসের এক পুরু চাদর। রেখে যাচ্ছি এক অতলান্তিক দূষিত ক্লেদাক্ত পৃথিবী। যে পৃথিবীতে থাকবে না বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস, থাকবে না পরিস্রুত পানীয় জল।

দিগন্ত বিস্তৃত দূষিত পৃথিবীতে তোমরা বড় হবে হাঁপানি-শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা রোগ, বদহজম, অকাল স্থূলতা, এমনকি কালান্তর ক্যান্সারকে নিত্যদিনের সাথী করে। তাই নিজেদের স্বার্থেই এবং তোমাদের ছেলেমেয়েদেরকে সুস্থভাবে  বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই আওয়াজ উঠুক ‘দূষণে হাঁসফাঁস করে, ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা মরতে চাই না। আমরা চাই-সুস্থ-সুন্দর-বিষহীন একটা গোটা পৃথিবী’। তোমাদের হাত ধরে এ আওয়াজ  স্কুল-কলেজে, পথে-ঘাটে, দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ুক সহস্ত্র কন্ঠে। যে বড়রা, অভিভাবকরা তোমাদের এই রকম একটা অসুস্থ সমাজ উপহার দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রশ্ন করো, 
‘বড়রা, তোমরা এ কী পৃথিবী রেখে যাচ্ছ আমাদের জন্য। আরো আরো ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের জন্য, তথাকথিত সুখী জীবনের জন্য তোমরা শুধু টাকার পিছনে ছুটছো। তোমাদের রেখে যাওয়া টাকা-ডলার চিবিয়ে আমরা তো প্রাণ ধারণ করতে পারবো না। বাঁচতে হলে লাগবে বিষহীন খাবার, দূষণহীন বাতাস আর পরিস্রুত পানীয় জল’। 

আন্তর্জাতিকস্তরে গড়ে ওঠা পরিবেশ আন্দোলনকে বিচার করার আগে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনতে হবে প্রকৃতি বাঁচানোর দাবিতে আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অসম কঠিন লড়াইয়ের ধারাবিবরণী। বৃহৎ বনানী কেটে ফেলার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রয়াত শ্রদ্ধেয় সুন্দরলাল বহুগুণার নেতৃত্বে আদিবাসী মানুষদের বুক দিয়ে গাছ জড়িয়ে চিপকো আন্দোলন; তেহরি ও নর্মদাতে জন-জীবন ও প্রকৃতি বিধ্বংসী বৃহৎ নদী বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে মেধা পাটেকরদের নেতৃত্বে হাজারো মানুষের লড়াই; পাহাড়-জঙ্গল ধ্বংস করে ও জনজীবন বিপর্যস্ত করে নিয়মগিরিতে ‘স্টারলাইট’ কোম্পানির বক্সাইট তুলে আনার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আদিবাসী জনজাতিদের দীর্ঘ লড়াই ও প্রাথমিক জয়ের বার্তা আলোকবর্তিকা হয়ে উঠে আসুক তোমাদেরই হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। 


তেজস্ক্রিয় দূষণ সৃষ্টিকারী পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের বিরুদ্ধে দেশজোড়া বিজ্ঞান কর্মীদের আন্দোলন ভরসা জোগাক তোমাদের মনে। সাম্প্রতিককালে থুগরা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও তিন লক্ষ গাছের মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানার বিপক্ষে আদিবাসী মানুষদের সাথে ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষক সমাজের লড়াইয়ের ওপর গভীর আস্থা থাকুক আঠারোর বুকে। দেউচা পাঁচামিতে খোলা-মুখ কয়লাখনির বিরুদ্ধে বা হাওড়ার ডুমুরজোলায় খেলার মাঠ ও গাছ বাঁচানোর দাবিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তোমাদের রোজকার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠুক। 
যশোর রোডে শতাব্দী প্রাচীন চার হাজার গাছ বাঁচানোর জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের লড়াই মিলে যাক সত্তর লক্ষ একর ঘন বনাঞ্চল ধ্বংস করে ও জনজীবন বিপর্যস্ত করে সরকারি মদতে বহুজাতিক কোম্পানির ‘তরল সোনা’ পেট্রোলিয়াম তুলে আনার চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাজনের আদিবাসী জনজাতিদের লড়াইয়ের সাথে। দেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি প্রকল্প ও তদজ্জনিত পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের লড়াই একই সুরে বেঁধে যাক জার্মানির কয়লাখনি বন্ধের দাবিতে যুবাবাহিনীর লড়াইয়ের সাথে।

 তোমাদের কাছে আহ্বান:

 বিপর্যস্ত প্রকৃতি পরিবেশের সমাধানের কথা ভাবতে হলে, পরিবেশ মেরামতের দাবিতে মাঠে নামতে হলে সবার আগে দরকার বিপর্যস্ত পরিবেশের নানান ভাঁজকে স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া। ভুউষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণগুলো ও শত্রুদের চিহ্নিত করা। তোমাদের এই বোঝাপড়া ছড়িয়ে পড়ুক বন্ধুদের মধ্যে রোজকার গল্প ও আড্ডার আসরে। বড়দের অভিজ্ঞতা ও সমর্থনকে পাথেয় করে পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে তরুণ সমাজ সোচ্চারে সামিল হোক, আঠারোর বজ্রনিনাদ নেমে আসুক সমাজের বুকে। গান বাঁধো- হাতে গিটার তুলে নিয়ে কণ্ঠ ছাড়ো জোরে। গান কবিতার সুর-লয়- ছন্দে উঠে আসুক পরিবেশ বাঁচানোর দাবি। ছোটরা নাটক ও শিল্পকলা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক শিক্ষাঙ্গনে, পাড়ায়-মহল্লায়। নিজেদের পড়াশোনা ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াইয়ের সাথে  যুক্ত হোক ‘প্রকৃতি মা’কে সুস্থ করে তোলার কঠিন লড়াই। পরিবেশ নিয়ে তোমাদের ভাবনা-কাজকর্ম ডালপালা মেলে শতধারায় বিকশিত হোক। বিকশিত হোক শতফুল। হাতে হাত রাখ-পায়ে পা মেলাও গ্রেটা থুনবার্গ, উগান্ডার তরুণী পরিবেশ কর্মী ভানিশা নাকিতে, আমাদের গর্বের বিনীতা উমাশঙ্কর ও দিশা রবি দের বিশ্বজনীন লড়াইয়ের সাথে। তবেই বাঁচবে তোমরা-বাঁচবে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এই নীল গ্রহ টিঁকে যাবে গাছপালা-জঙ্গল-নদী-পুকুর, অণুজীব থেকে বৃহৎ প্রাণ সহ তামাম জীব-বৈচিত্র। টিকে যাবে মানব সভ্যতা। এসো,  তারুণ্যের জয়গান, জীবনের জয়গান গাই।

লেখক: বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মী

Contact:santoshsen66@gmail.com