Hijab : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব বিতর্ক:সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন?

Hijab : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব বিতর্ক:সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন?

ছবি সংগ্রহ 

ড . বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ

দৃশ্য ১:সন টা একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের একটা সময়।তখন সম্ভবত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাস এ রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন এর জন্য পড়াশোনা করছি। জাত পাত নিয়ে কোনোদিনই মাথা ব্যথা ছিলনা।দু এক জন বন্ধুও ছিল যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী।বেশ মিষ্টি দেখতে ছিল আসমা আর নাজরীন কে।বাস থেকে নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ  করার পর হিজাব টি খুলে ব্যাগে নিয়ে নিত।আবার ছুটি হলে পরে নিত।আমার বেশ ভালো লাগতো ওদের।একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললাম।যে ওরা এমনটা করে কানো?উত্তরে শুনলাম ওদের মোটেও পড়তে ভালো লাগে না।কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী বা চেনা মানুষ রাস্তায় ওদের হিজাব ছাড়া দেখলে খারাপ মনে করতে পারে তাই ওরা এমনটা করে।তো আমি বললাম তোদের কিন্তু বেশ লাগে এটা পরে।তারপর বললাম এটা কি বোরখা?তার উত্তরে ওরা বললো না এটি হিজাব বা নেকাব যা মাথা এবং বুক আবৃত করে থাকে, এবং যা নির্দিষ্টভাবে বয়ঃসন্ধি বয়স থেকে মুসলিম নারীদের কর্তৃক পরিহিত হয় তাদের পরিবারের বাইরের প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রত্যক্ষতা এড়াতে।

স্বাভাবিকভাবে,শালীনতাবোধ, গোপনতা এবং নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে মুসলিম নারীদের কর্তৃক হিজাব পরিহিত হয়ে থাকে।ওরা বললো তোরা যেমন ওড়না  বা স্কার্ফ পরিস এটা কিছুটা তেমনি।যে কোনো পোশাকের উপরেই এত পরা যায়।আরবিতে হিজাব পদের সাহিত্যিক অর্থ “একটি অন্তঃপট বা পর্দা” এবং কোরআনে বিভাজন নির্দেশ করতে এটি ব্যবহৃত হয়েছে।যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি পুরুষ কতৃর্ক নারীদের নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।যাইহোক একদিন অফ পিরিয়ডে আমার মনে হলো একটু  স্কার্ফ টা  (হিজাব) পরে  আয়নায় মুখটা দেখলে কেমন হয়? বন্ধু আসমাকে বললাম। ও তো বেজায় মজা পেল।চুপি চুপি লেডিস টয়লেট এ গিয়ে ও আমায় পরিয়ে দিল।বললো হেব্বি লাগছে তোকে।কেউ বলবেই না যে তুই আমাদের কেউ নোস।খুব ভালো লাগছিল সেদিন বললাম আমরা সবাই এক।তোদের এই পোশাকের অংশটা মন্দ নয় কিন্তু।ব্যাস আর কোনো মাথা ব্যথা ছিলনা এটা নিয়ে।

দৃশ্য ২: ২০১২ তে শিক্ষণ মন্দিরে অধ্যক্ষ পদে যোগদান।এটি হুগলীর বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান ।বেশ কিছু শিক্ষার্থী আছেন যাদের ধর্ম মুসলিম।গত বছরেও আমার রাষ্ট্র বিজ্ঞান মেথডের ক্লাসে একটি শিক্ষার্থী ছিল বেশ মেধাবী এবং যথেষ্ট serious। নাম পারভিন ও সর্বদাই বোরখা ও হিজাব ব্যবহার করতো।আর সব কিছুতেই ওর আগ্রহ দেখতাম।যেকোনো কাজ  দিলে নিমেষে করে দিত।আমার খুব প্রিয় ছিল।কিন্তু ওর পোশাক নিয়ে কোনো দিনই প্রতিষ্ঠানের কারও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি।এই প্রতিষ্ঠানে পোশাক নিয়ে আমরা কখনই চিন্তা করিনি।শিক্ষাটাই মুখ্য বিষয়।

দৃশ্য ৩:গত পরশু রাতে মুঠোফোন খুলতেই চোখে পড়লো সেই বিতর্কিত ভিডিও।যেখানে কর্ণাটকের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুস্কান  কে কেন্দ্র করে উঠেছে বিতর্কের ঝড়।কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ কালে তার পরনে হিজাব।একদল চিৎকার করে শ্রীরাম ধ্বনি দিয়েছেন। তার সঙ্গে পাল্টা ধ্বনি আল্লাহ আকবর।পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে জারী হয় কারফিউ আর বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্ক।বিষয়টি আপাতত আদালতে বিচারাধীন।কলকাতায় আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা নেমেছে পথে যে ভারতের মতো সেক্যুলার দেশে এ হেন আচরণের অর্থ কি এটাই তাদের প্রশ্ন।

এসব খবর দেখলে ব্রিটিশ শাসনের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি মনে পড়ে। একোন ভারতের মুখ দেখছি আমরা।একদিকে যেখানে চলে স্বাধীনতার বর্ষ পূর্তি উৎসব অন্যদিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি একটা অন্ধকার , অশিক্ষিত , মূল্যবোধহীন প্রজন্মের দিকে। রাজ্যের প্রধান বহন করছেন ধর্মীয় পোশাক? আমাদের ভবিষ্যৎ তবে কি?জাতপাত ,ধর্ম, বর্ণ,লিঙ্গ এসব নিয়ে খেও খেই নাকি সম্পদ পূর্ণ ভারত কে তার আগামী প্রজন্মকে একটা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখানো?কাল আমার আপনার সন্তান যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মের জন্য দাঙ্গা তৈরি করে তবে আমাদের কি করণীয় থাকবে?

ভারতীয় সংবিধানের 29 নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে, ভারতে বসবাসকারী সমস্ত নাগরিকদের স্বতন্ত্র লিপি, ভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার থাকবে। সরকারি অনুদানে পরিচালিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে জাতি, ধর্ম ,সম্প্রদায় ভাষা অথবা যেকোনো একটি বিষয়ের অজুহাত দিয়ে ভারতীয় কোনো নাগরিককে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। 29 (2) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালিত বা সাহায্যপ্রাপ্ত কোন বিদ্যালয় ধর্ম, জাতি সম্প্রদায় কিংবা ভাষার অজুহাতে কোন ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি নিয়ে অস্বীকার করা যাবে না। 

তবে কানো এই বিরোধ?এর পশ্চাতে কি যুক্তি আছে?কোনো নারী যদি স্ব ইচ্ছায় হিজাব বা যেকোনো পোশাক পরেন ঘোমটা দেন,বা ওড়না পরেন তাতে কার কি অসুবিধে?তার সঙ্গে শিক্ষার ফলাফলের কোনো যোগ আছেকি?সম্প্রতি বিশ্ব বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বা ইউজিসি (UGC) উল্লেখ করে যে শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে তারা আলোকপাত করলেও পোশাক সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের কোনো নির্দেশিকা নেই।কিন্তু তাহলে এত দূর ঘটনা গড়ায় কিভাবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছে এগুলো একধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানি যা রাজনৈতিক স্বার্থকে সামনে রেখে উদ্ভূত আর ভারত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে নষ্ট করছে এবং ভারত এককালে যে সৌভাতৃত্বর জন্য সারা বিশ্বে সম্মানিত হয়ে এসেছে যে শান্তির পথ দেখিয়েছে দেশের মহামানবগণ তার মূলে কুঠারাঘাত করছে এই ধরনের ঘটনা।যা কোনো মতেই মেনে নেওয়া যায় না।আশা করা যায় এই ধরনের ঘটনার প্রতি আদালত উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।এবং সর্বতোভাবে যাতে এগুলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা উস্কানি মূলক কাজে রূপান্তরিত না হয় এটাও আমাদের কামনা থাকবে।ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে এই ধরনের নোংরা মানসিকতা বহন না করে তার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষকদের অধিক সক্রিয় হতে হবে। স্বচ্ছ হতে হবে দেশের বিচারালয় কেও।নাহলে আসমার মত বন্ধু বা পারভিন এর মত ছাত্র দের সঙ্গ আমরা আর পাবনা।


জয় শ্রী রাম আর আল্লাহ্ আকবর আমাদের জয়হিন্দ  বলতে ভুলিয়ে দেবে নাতো?

লেখক : ড. বিরাজলক্ষী ঘোষ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সমাজ চিন্তক ও পরিবেশ সংগঠক