Sleep is life : ঘুমই জীবন : ‘গুনগত ঘুম, সুস্থ্য মন, সুখী পৃথিবী’

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু
‘বিশ্ব ঘুম দিবস উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন’
১৮ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস। প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় শুক্রবার দিবসটি পালিত হয়। ভালো থাকার জন্য ভালো ঘুম হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তবে অনেকেই আছেন যাদের মোটেও ভালো ঘুম হয় না। আমেরিকার জাতীয় নিদ্রা ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সেখানে বড়দের মধ্যে শতকরা ৬০ জনই সপ্তাহে দু’রাত বা তার বেশি সময় ঘুমজনিত সমস্যায় ভোগেন। শতকরা ৪০ জনের বেশি লোক মাসে অন্তত দু’দিন অতি দিবা নিদ্রালুতায় আক্রান্ত হয়ে দৈনন্দিন কাজে বাধাগ্রস্ত হন। সপ্তাহে দু’দিন এ ধরনের সমস্যায় পড়েন, এমন আছেন শতকরা ২০জন। আমেরিকায় অন্তত ৪ লাখ লোক নিয়মিত ঘুমের সমস্যায় ভোগে। বড়দের ৫ ভাগ স্লিপ অ্যাপনিয়া আক্রান্ত। শিশুদের ভেতর এ হার ২-৩ ভাগ। তবে যেসব শিশুরা নাক ডাকে, তাদের ভেতর স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগী আছে ১০-২০ ভাগ।
নিদ্রাকালীন শ্বাসরুদ্ধতা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া। অ্যাপনিয়া মূলত একটি গ্রিক শব্দ। যার অর্থ শ্বাসহীনতা। স্লিপ অ্যাপনিয়া তিন রকমের
১. নাক ও গলায় বাধাজনিত
২. মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত এবং
৩. মিশ্র ধরণের
অ্যাপনিয়া অর্থ শ্বাসহীনতা। এতে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট হয়। বড়দের ৫ ভাগ স্লিপ অ্যাপনিয়ায় আক্রান্ত। শিশুদের মধ্যে এ হার ২-৩ নিদ্রাকালীন শ্বাসরুদ্ধতা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া। স্লিপ অ্যাপনিয়া তিন রকমথ ১. নাক ও গলায় বাধাজনিত, ২. মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত এবং ৩. মিশ্র ধরনের প্রতিক্রিয়া। তিন প্রকারের মধ্যে বাধাজনিত অ্যাপনিয়া রোগী সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। অ্যাপনিয়া চিকিৎসা না করা হলে রোগীর শ্বাস বারবার কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে। কখনো সারারাত শতবার এমন হয়। কখনো আবার এক-দু'মিনিটের জন্য হতে পারে। মস্তিষ্কে কোনো কারণে অ্যাপনিয়া হলে যেসব মাংসপেশী শ্বাস নেওয়ার কাজ করে তারা সংকেত পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকে। মিশ্র কারণে হলে এক সঙ্গে দুটো প্রক্রিয়াই জড়িত থাকে। প্রতিবার অ্যাপনিয়া হলে মস্তিষ্ক অল্প সময়ের মধ্যে রোগীকে জাগিয়ে দেয়। উপসর্গ : অবস্ট্রাক্টিভ স্লিপে উচ্চশব্দে নাক ডাকে। নাক ডাকার ধরনটি হয় অস্বাভাবিক। থেমে থেমে নাক ডাকে।
অন্যান্য উপসর্গ :দিবাভাগে মাত্রাতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব। স্মৃতি বিভ্রম। হতাশা, বদমেজাজ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা, মোটা হয়ে যাওয়া, মানসিক অসুস্থতা বিবাহ বিচ্ছেদ, ক্যান্সার, আয়ু কমে যাওয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং হার্টের নানা অসুখ ইত্যাদি।
রোগ নির্ণয় : ঘুমের বিভিন্ন স্তর পর্যবেক্ষণ, অ্যাপনিয়া রোগ নির্ণয়, মাত্রা ও গুরুত্ব এবং সেভাবেই চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে স্লিপ ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা আছে।
চিকিৎসা : অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে ফেলা; অ্যালকোহল, ধূমপান, অতিরিক্ত চা কফি পান ও ঘুমের ওষুধ সেবন এড়িয়ে চলা; এক পাশে কাৎ হয়ে শোবার অভ্যাস করা। এ ছাড়া নাক বন্ধ থাকার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। সিপিএপি বা কন্টিনিউয়াস পজিটিভ এয়ারওয়ে প্রেসার বা একনাগাড়ে শ্বাসতন্ত্রে বায়ুর চাপ বাড়িয়ে রাখা যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা বেশ কার্যকর। এতে ঘুমের সময় একটি মাস্ক বা মুখোশ পরিয়ে দেওয়া হয় এবং উচ্চ চাপের বাতাস বইয়ে দিয়ে শ্বাসতন্ত্রকে খোলা রাখা হয়। বিভিন্ন রোগের জন্য দরকার হয় বিভিন্ন আকারের মাস্ক আর বিভিন্ন মাত্রার চাপ। এগুলো নির্ধারনের জন্য চিকিৎসকের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন। রয়েছে মুখ খুলে রাখার জন্য মুখগহ্বরে ব্যবহার্য যন্ত্র। রয়েছে ইউপিপিপি অর্থাৎ ইউভুলোপ্যালাটো ফ্যারিঙ্গাপ্লান্টি নামক ইএনটি অপারেশন। এতে সার্জন গলার পেছন অংশে ইফভুলো বা আলা জিহ্বা, তালু ও গলানালীর কোমল টিস্যুগুলোকে অপসারণ করে শ্বাসতন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা দূর করে থাকেন স্লিপঅ্যাপনিয়া নির্ণয়ের জন্য ঘুমের প্রকৃতি, চোখের নড়াচড়া, মাংসপেশীর তৎপরতা, হৃদযন্ত্রের গতি, নিঃশ্বাসের জন্য প্রয়াস, বাতাসের গতি এবং রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা এই সব উপাদান মনিটর করা হয়। এভাবে স্লিপ অ্যাপনিয়া যমন নির্ণয় করা যায়, তেমনি এর গভীরতাও বোঝা যায়। কখনো কখনো ১ম রাত থেকেই চিকিৎসা শুরু করা যায়।
এই কথা এখন সঙ্গত কারণেই বলা যায়, স্লিপ অ্যাপনিয়ার উপসর্গগুলো জেনে রাখা জন- সাধারণের জন্য যেমন জরুরী তেমনি প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা সেবা যারা করে থাকে, সেই ডাক্তার সাহেদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার ছিলো রোগীকে, কেমন হচ্ছে তাদের ঘুম ঘুম। তার কি নিরাপদে ঘুমাচ্ছেন?
পর্যাপ্ত না ঘুমালে কী হয়?
ঘুমের অভাবে হার্ট অ্যাটাক, হার্টের অসুখ, অনিয়মিত হার্টবিট, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা হতে পারে। ঘুম কম হলে কার্টিসল নামের একটা হরমোন নিঃসরণ হয়। এটা ত্বকের কোলাজেন ভেঙে ফেলে। যাঁরা দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমান, তাঁদের মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অন্যদের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি থাকে। কম ঘুমানোর সঙ্গে অবসাদগ্রস্ততার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। স্মৃতি হারিয়ে ফেলা, স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলা, ভুলে যাওয়া রোগ, ইনসোমনিয়া, হ্যালুসিনেশনসহ নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে।
কেন ঘুমাব?
ঘুম আমাদের মেটাবলিজম সিস্টেম আর ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। জীবনে স্থিতি দেয়। ইমিউন সিস্টেমকে সক্রিয় করে। হৃদ্রোগের সম্ভাবনা কমায়। লং আর শর্ট টার্ম মেমোরি গুছিয়ে রাখে। স্মৃতিশক্তি গুছিয়ে জড়ো করে রাখে। শারীরিক, মানসিক ও মস্তিষ্কের কার্যক্রম ঠিক রাখার জন্য জীবনের মোট সময়ের তিন ভাগের এক ভাগ ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। আট ঘণ্টা ঘুম মস্তিষ্কের কার্যক্রমকে সবচেয়ে ভালো রাখে। আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি, তখন এমন কিছু কার্যক্রম চালু হয়, যেগুলো জীবনের জন্য খুবই জরুরি। শরীর ও মনের ঠিকভাবে ফাংশনের জন্য, ‘কোয়ালিটি লাইফ’-এর জন্য প্রতিদিন তাই আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
লেখক : অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু, জেনারেল সেক্রেটারি, ‘অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া বাংলাদেশ’ এমবিবিএস (ডিএমসি), এমএস (ইএনটি এন্ড হেড-নেক সার্জারী) এফআরসিএস (গ্লাসগো), এফএসিএস (আমেরিকা), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফেলো, এন্ডোস্কপিক সার্জারী মাইক্রোইয়ার সার্জারী, ভয়েজ সার্জারী, থাইরয়েড সার্জারী, লেজার, রবোটিক এন্ড স্লিপ অ্যাপনিয়া, সার্জারীতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত (ইউএসএ, ভেলোর, মাদ্রাজ, মুম্বাই, দিল্লী ও সিংগাপুর), জেনারেল সেক্রেটারি এসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ এপনিয়া বাংলাদেশ, (এক্স)-অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ইএনটি এন্ড হেড-নেক সার্জারী বিভাগ) স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা, বর্তমানে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল