World Refugee Day বিশ্ব শরণার্থী দিবস: যুদ্ধ, সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বাংলাদেশে
‘বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ ও সংঘাতে খাদ্য সংকট বাড়ছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেনস্ট ফুড ক্রাইসিস জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থাটি সম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী খাদ্য সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, চলমান যুদ্ধ, সহিংসতা এবং নিপীড়ন ইত্যাদি কারণে খাদ্যসংকটের পাশাপাশি শরণার্থীর নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে’
জেসমিন প্রেমা
দুই বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বজুড়ে করোনা অতিমারির প্রাদুর্ভাব ছিলো। তখন সাধারণ মানুষের চলাফেরা সীমিত পর্যায়ে নেমে। কিন্তু যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন কারণে ৩০ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থীর খাতায় নাম লিখিয়েছে।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুসারে ২০২০ সালের নাগাদ বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৪ লাখ। বিশ্বের মোট শরণার্থীর মধ্যে এককভাবে তুরস্ক আশ্রয় দিয়েছে ৩৬ লাখ শরণার্থীকে। যা কিনা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-২০২০ মাত্র দুই বছরে শরণার্থী হিসেবে ১০ লাখ শিশু জন্ম নিয়েছে।
জেসমিন প্রেমা
২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে ২০০১ সালের ২০ জুন থেকে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই দিনটি বেছে নেয়ার কারণ হচ্ছে, ১৯৫১ সালে শরণার্থীদের অবস্থান নির্ণয়-বিষয়ক একটি কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০১ সালে। অবশ্য ২০০০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকান শরণার্থী দিবস নামে একটি দিবস কয়েকটি দেশে পালন করা হতো। যা কিনা এখন জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এখন বিশ্বের মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ শরণার্থী।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) গত ২৩ মে এক বিবৃতিতে বলেছে যে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ৬০ লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে গেছে। এ নিয়ে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ছুঁয়েছে।
শরণার্থী
ইউএনএইচসিআর বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনক যা বিশ্বকে যুদ্ধ বন্ধের তাগিদ দেয়। যুদ্ধ রেকর্ড সংখ্যক মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের এই সংখ্যাকে তথা সতর্কবার্তা ওয়েক-আপ-কল উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি।
বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধ ও সংঘাতে খাদ্য সংকট বাড়ছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এগেনস্ট ফুড ক্রাইসিস জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত সংস্থাটি সম্প্রতি পৃথিবীব্যাপী খাদ্য সংকট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, চলমান যুদ্ধ, সহিংসতা এবং নিপীড়ন ইত্যাদি কারণে খাদ্যসংকটের পাশাপাশি শরণার্থীর নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালে ৫৩টি দেশ বা অঞ্চলের প্রায় ১৯.৩ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে ছিল। ২০২০ সালের তুলনায় এসব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪ কোটি। যার মধ্যে ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কারের দক্ষিণাংশ, দক্ষিণ সুদান ও ইয়েমেনের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। এ সব দেশের মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। অনাহার ও মৃত্যু এবং জীবিকার পথ সচলে জরুরি পদক্ষেপের তাগিদ দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
জলবায়ু সংকট, পরিবেশ বিপর্যয়, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে এমন চিত্র সামনে এসেছে। ২০২১ সালে নানা সংঘাতের কারণে সব চেয়ে বেশি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়েছে। যা কিনা পৃথিবীর ২৪টি দেশের ১৩.৯ কোটি মানুষকে তীব্র খাদ্য সংকটে মুখে ঠেলে দেয়। ২০২০ সালে ২৩টি অঞ্চলের ৯.৯ কোটি মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে পড়েছিল। এক বছরে নতুন করে খাদ্য সংকটের মিছিলে যুক্ত হয় আরও ৪ কোটি মানুষ।
শিশু আয়নালের এই মৃত্যু বহু মানুষের চোখের জল ঝরিয়েছিলো
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা শরণার্থীর ৭০ শতাংশই পাঁচটি দেশের। যার মধ্যে সিরিয়া ৬৮ লাখ, ভেনেজুয়েলা ৪৯ লাখ, আফগানিস্তান ২৮ লাখ, দক্ষিণ সুদান ২২ লাখ এবং মিয়ানমার থেকে ১১ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।
এসব মানুষদের তাৎক্ষণিক সুরক্ষা এবং সহায়তা দিতে অস্থায়ীভাবে কোন দেশ হয়তো আশ্রয় দিয়ে থাকে। কিন্তু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় কোন স্থায়ী সমাধান নয়। আপতকালীন সময়ে এসব শরণার্থীদের শিবিরে আশ্রয়ের পাশাপাশি মৌলিক সুবিধা খাদ্য, পানি, চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। জাতিসংঘ বলছে, করোনা মহামারির কারণে বাস্তুচ্যুতির হার কমলেও বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালে ১১ লাখ মানুষ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ ৮ কোটি ২৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুতির শিকার। যার মধ্যে ৪২ শতাংশ তরুণ ও তরুণীর বয়স ১৮-এর নিচে।
মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ইত্যাদি অমানবিক অত্যাচর থেকে পরিত্রাণ পেতে ২০১৭ সালে প্রায় ৭ লাখ বাস্তুচ্যূত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।
শরণার্থী শিশু
২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৩ তম জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থীদের পরিসেবা, শিক্ষা, খাদ্য, বিষুদ্ধ পানি এবং সঠিক স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংক্রামক রোগ সংক্রমণেও ঝুঁকিপূর্ণ।
কলকাতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের গবেষক ড. রূপ কুমার বর্মণের মতে বাস্তুচ্যুতি, রাষ্ট্রহীনতা, উদ্বাস্তু, শরণার্থী ও নাগরিকত্বের সমস্যায় সমগ্র পৃথিবী জর্জরিত। আর আম্বেদকর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. রূপ কুমার বর্মণ গত ২০ বছর ধরে এ বিষয়ে গবেষণা করে চলেছেন।
লেখক : জেসমিন প্রেমা চেয়ারম্যান, সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)